লিখেছেন: পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান
জনাব মাহমুদুল হক চৌধুরী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, উখিয়া, কক্সবাজার। আমি রাজনীতিবিদ মাহমুদুল হক চৌধুরীর কথা বলছি না, বলছি ব্যক্তি মাহমুদুল হক চৌধুরীর কথা। উনার রাজনীতি স্বচক্ষে দেখিনি কিন্তু এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে ওনার অনেক সুনাম শুনেছি। ঠিক তারই প্রতিফলন দেখলাম আজকে। চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় চাকরির সুবাদে প্রায় প্রতিনিয়ত থানার সকল অফিসারদের বিভিন্ন বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে উদ্ভূত বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। আমানত শাহ মাজার, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন সহ আশেপাশে বিভিন্ন ভাসমান লোকজনের আস্তানা থাকার কারণে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যাটা অনেক বেশি। সবচেয়ে কষ্ট হলো বেওয়ারিশ লাশের ওয়ারিশ খুঁজে বের করা। ম্যানুয়ালি সকল চেষ্টা ব্যর্থ হলে চলে সিআইডি এবং পিবিআই এক্সপার্ট দ্বারা ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর মাধ্যমে পরিচয় সনাক্তের কাজ। অনেক কষ্টে পরিচয় শনাক্ত করা গেলেও পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে দেখা যায় দীর্ঘদিন ধরে ঘর ছাড়া এসব ছন্নছাড়া মানুষগুলোকে পরিবার যেন নিজ বাড়িতে নিতে চায় না। পারিবারিক কবরস্থান কিংবা গ্রামের মসজিদের কবরস্থানে শেষ নিদ্রার যেন তাদের কোন অধিকার নেই। তখন আমাদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম সম্পূর্ণ বিনা খরচে নিজেদের দায়িত্বে লাশ জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করলেও সবকিছু গুছিয়ে দিতে ১০০০/১৫০০ টাকা আমাদের পকেট থেকে খরচ হয় যে খরচ টাকে আমরা সবসময় আশীর্বাদ মনে করি। আজকে মোবাইল ডিউটিতে থাকাকালীন সময়ে এসআই তোফাজ্জল হোসাইন স্যার ঠিক এমনই একটি লাশ পেয়েছিল চেরাগির পাহাড় মোড়ে। বেচারা অনেক কষ্টে লাশের সামান্য পরিচয় বের করে আমাকে দিয়ে বলল তোমার থানা এলাকার যদি পারো একটু পরিচয়টা সনাক্ত করে দাও, অন্তত শেষ ঘুমটা না হয় নিজ গ্রামের কবরস্থানের মাটিতে ঘুমাক। রাত ৯টা থেকে সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত চলল লাশের পরিচয় সনাক্তের চেষ্টা। এর মধ্যে লাশ নেওয়ার জন্য আসা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের লোকজনকে বসিয়ে রাখা হলো পাক্কা আড়াই ঘন্টা। খানিকটা পরিচয় সনাক্ত করা গেলেও লাশ নেওয়ার জন্য আগ্রহী কাউকে পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে লাশটি আঞ্জুমানকেই দিয়ে দেওয়া হলো। আঞ্জুমান লাশ নিয়ে গোসল করিয়ে লাশের গায়ে কাফন পরিয়ে জানাজাটা দেওয়া বাকি, এরই মধ্যে আমাকে মোবাইলে কল করলেন জনাব মাহমুদুল হক চৌধুরী। আমার কাছ থেকে জানতে চাইলেন লাশের জানাজা হয়েছে কিনা। আমি তাৎক্ষণিক খবর নিয়ে জানলাম লাস্ট জানাজার জন্য রেডি ২ মিনিটের মধ্যে জানাজা হয়ে যাবে। উনাকে মোবাইলে কল করে জানাতেই উনি বললেন “আমার জন্য দশটা মিনিট অপেক্ষা করতে বলো আমি নিজে এসে জানাজা পড়বো”। আমি সারাদিন অফিস শেষ করে মাত্র বাসায় আসলাম তখনো কাপড় ছাড়িনি। ফোন করে বলে দিলাম জানাজা দশ মিনিট পরে করেন আমরা কয়েকজন লোক আসবো জানাযা পড়তে। যথারীতি আমার সাথে সাথে জনাব মাহমুদুল হক চৌধুরীও পুরাতন স্টেশন রোড, ২২ মহল্লা কবরস্থান, চৈতন্য গলি উপস্থিত হলেন। নিজ চোখে লোকটিকে দেখে বললেন এই লোকটা আমার পাশের গ্রামের। আমি কোনভাবেই একে বেওয়ারিশ হিসেবে এখানে দাফন করতে দিবো না। তার পরিবার না আসলে আমি নিজেই নিয়ে যাব একে। আমার গ্রামের লোক কেন বেওয়ারিশ হিসেবে চট্টগ্রামের কবরস্থানে থাকবে। সাথে সাথে এলাকার মেম্বারকে ফোন করে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে পাঠালেন। তার পরিবার রীতিমতো ইতস্তত বোধ করছিল এত টাকা গাড়ি ভাড়া খরচ দিয়ে কিভাবে লাশ তারা নিয়ে দাফন করবে। জনাব মাহমুদুল হক চৌধুরী বললেন তোমাদের কোন খরচ করতে হবেনা গাড়ি ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ সব আমি দিয়ে দিব, তোমরা শুধু জানাজা এবং দাফনের ব্যবস্থা করো। সাথে সাথে এম্বুলেন্স ডেকে নিজ হাতে দস্তখত করে লাশ বুঝে নিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। আর রফিক মেম্বারকে বলে দিলেন যত ভোর সকালে হোক লাশটা যেন কষ্ট করে কোর্ট বাজার থেকে রিসিভ করে নিয়ে যায়। মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধাটা অনেক বেশি বেড়ে গেল। অবশেষে জনাব মাহমুদুল হক চৌধুরীর সামান্যতম চেষ্টায় যেন একটি লাশ তার পরিচয় খুঁজে পেল।
আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে একটি সুন্দর, যন্ত্রনাহীন সাবলীল মৃত্যু দান করেন, এবং মৃত্যুর পর যেন আমাদের পরিবার-পরিজনের আশেপাশেই আমাদের দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেন, আমিন।